মহিষীগণ ভগবানের
বৃন্দাবন-লীলা জানার জন্য কৌতুহলী হয়ে উঠলেন । কি এমন
সেখানে হয়েছিল যে প্রভু তা ভুলতে পারছেন না ?------- "কিন্তু
আমাদের প্রিয় স্বামীর শৈশবলীলা---- যখন তিনি শিশুরুপে
বৃন্দাবনে লীলা করেছেন সেই লীলা কথা কে আমাদের বলতে
পারে ?" তাঁরা জানতে পারলেন যে মাতা রোহিণী
ভগবানের বৃন্দাবন লীলা প্রক্যক্ষভাবে দর্শন করেছিলেন
এবং তাঁদের মহা সৌভাগ্য যে তিনি এখন দ্বারকায় বাস
করছেন । একদিন সকল মহিষীগণ কৌতুহল চিত্তে
রোহিণীদেবীর কাছে গিয়ে কৃপাপূর্বক ভগবানের কৈশোর-
যৌবন লীলা তাঁদেরকে বলার জন্য নোহিণীদেবীক
আহ্বান করলেন । মাতা রোহিণী উপলব্দি করলেন যে
রাণীগণ ভগবানের ব্রজলীলা শ্রবণের জন্য আগ্রহ হয়েছে ।
তিনি বললেন, "বাস্তবিকই শ্রীকৃষ্ণের ব্রজবিলাস-লীলা
অনোন্য, অনুপম-এতই বিশিষ্ট এই লীলা যে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ও
এই লীলা মহিমা শ্রবণ করে এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন । আমি
আপনাদের কাছে ঐসব অপূর্ব বিষ্ময়কর ব্রজলীলা বর্ণনা
করতে পারি । কিন্তু একটি শর্তেঃ আমি যখন সেইসব লীলা
কাহিণী বর্ণনা করব, তখন কৃষ্ণ বলরাম যেন শ্রবণ করতে না
পারে । যদি তাঁরা শ্রবণ করে, তাহলে বড় আকারের সমস্যার
সূচনা হবে ।" একবার কৃষ্ণ ও বলরাম দ্বারকার সুধর্ম সভাগৃহে
একটি সভায় যোগদানের জন্য গমন করলেন । তখন শ্রীকৃষ্ণের
সকল মহিষীগণ তাঁদের অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করলেন ।
তাঁরা সকলে একটি প্রশস্ত কক্ষে সমবেত হয়ে রোহিণী
মাতাকে শ্রীকৃষ্ণের শৈশব লীলা বর্ণনা করার অনুরোধ
করলেন । ঐ দুই ভাই, কৃষ্ণ - বলরাম যাতে এই বর্ণনা শ্রবণ করতে
না পারে, সেটা নিশ্চিৎ করার জন্য মাতা রোহিণী
সুভদ্রাদেবীকে দ্বাররক্ষীর সেবা গ্রহণ করতে বললেন । ঠিক
হল তিনি ওখানে কৃষ্ণ -বলরামের আগমন হলে
রোহিণীমাতাকে ইঙ্গিতে জানিয়ে দিবেন । এখন সবকিছুই
প্রস্তুত । সমস্ত মহিষীগণ প্রবল আগ্রহে ও উত্তেজনায় সেখানে
রোহিণীমাতাকে ঘিরে সমবেত । সুভদ্রা সেই প্রশস্ত কক্ষের
দ্বারে তাঁর দুই হাত বিস্তার করে দ্বার রোধ করে দাঁড়িয়ে
আছেন, যাতে কেউ ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে, বিশেষতঃ
কৃষ্ণ- বলরাম । রোহিণীমতিা আনন্দিত অন্তরে ব্রজবৃন্দাবনে
শ্রীকৃষ্ণের শৈশবলীলা বর্ণনা আরম্ভ করলেন । সেই বর্ণনা
ছিল পরম প্রীতিকর, শ্রবণরম্য এবং দিব্য ভাবোচ্ছাসপূর্ণ।
মহিষীগণ অচ্ছিন্নমনোযোগে শ্রবণ করতে লাগলেন । তাঁরা
রোহিণীমাতার মুখনিঃসৃত ব্রজবিলাসকথা-রুপ সুধামৃতধারা
তাঁদের কর্ণের দ্বারা পানে এতই নিমগ্ন হয়ে পড়লেন তাঁদের
বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে গেল । সুভদ্রা যদিও দ্বাররক্ষার
দ্বায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছিলেন, তিনি শ্রীকৃষ্ণের অনুপম
লীলাবিলাস-কথা শ্রবণের সুযোগটি অপচয় করতে পারলেন না
। আর এইভাবে শ্রবণে নিমগ্ন হওয়ায় দ্বারকার মহিষীদের
মতোই তাঁরও বাহ্যজ্ঞান লোপ পেল । কৃষ্ণ- বলরাম সভায়
যোগদান করে সেখানে ব্যস্ত থাকলেও তাঁরা বুঝতে পারলেন
যে মাতা রোহিলী তাঁদের বৃন্দাবন লীলাকথা বর্ণনা করছেন
। ঐকথা শ্রবণের জন্য সুতীব্র লালসায় অভিভূত হয়ে তাঁরা
হঠাৎই সভাগৃহ পরিত্যাগ করে সেই স্থানের দিকে ধাবিত
হলেন, যেখানে রোহিণীদেবী ও রাণীগণ সমবেত হয়েছিলেন
। যখন তাঁরা দ্বারে পৌছালেন, তখন তাঁরা দেখলেন যে
সুভদ্রা কক্ষদ্বার পাহাড়ার দ্বায়িত্বে সেখানে দাঁড়িয়ে
আছেন । কৃষ্ণ-বলরাম সুভদ্রার উভয় পাশে দাঁড়ালেন এবং
তৎক্ষণাৎ তাঁরা মাতা রোহিণীর বর্ণনা শ্রবণে নিমগ্ন হলেন
সুভদ্রা ব্রজকথা শ্রবণে সম্পূর্ণ তন্ময় হওয়ায় তাঁর বাহ্য চেতনা
বিলুপ্ত হয়েছিল, সেজন্য তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও
শ্রীবলরামের উপস্থিতি লক্ষ্য করলেন না । তাঁরা তিনজন
এইভাবে লীলা শ্রবণের দ্বারা ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়লেন, তখন
তাঁদের দিব্য দেহে মহা ভাববিকার-লক্ষণ প্রকটিত হতে শুরু
করল । " কি পরমাদ্ভুত, দিব্যসুন্দর লীলা ! ব্রজবাসীগণের কি
অবর্ণনীয় স্নেহ-প্রেম !" ব্রজবাসীদের অদ্ভুত প্রীতি-প্রেম-
বিরহ শ্রবণে বিষ্ময়াভিভুত হওয়ায় তাঁদের দিব্য অঙ্গ
ভাবতরঙ্গে পরিপ্লুত হল । ভাবাতিশয্যাবশতঃ তাঁদের নয়ণ
ক্রমশঃ বড়, বিস্ফোরিত হতে শুরু করল, তাঁদের হস্ত -পদ তাঁদের
দেহের সধ্যে সংকুচিত হল । এইভাবে হস্ত- পদাদির সংকোচন
হওয়ায় কৃষ্ণ-বলরাম এবং সুভদ্রার কলেবর কুর্মাকৃতি ধারণ করল
। ঠিক সেই সময়ে নারদ মুনি উপস্থিত হলেন । অনেক দূর থেকে
তিনি কৃষ্ণ-বলরাম ও সুভদ্রার এই অদ্ভুত ভাবমন্ডিতরুপ দর্শন
করতে পারছিলেন যখন তিনি তাঁদের নিকটবর্তী হলেন, তখন
কৃষ্ণ, বলরাম ও তাঁদের ভগ্নী সুভদ্রার বাহ্য চেতনা ফিরে এল ।
তাঁদের দেহ স্বাভাবিক আকার ধারণ করল । তাঁরা তাঁদের
মহাভাব সংবরণ করলেন, যা তাঁদের এই বিশেষরুপে অভিব্যক্ত
হয়েছিল । নারদ মুনি দিব্য আনন্দোল্লাসে দুবাহু তুলে নিত্য
করতে লাগলেন । তিনি বললেন, " আমি দর্শন করেছি ! আমি
দর্শন করেছি ! আপনারা আমার কাছ থেকে এটি সংগোপন
করার চেষ্টা করছেন । হে প্রিয় প্রভু, আমি আপনার অনেক
আশ্চর্যজনক দিব্যরুপ দর্শন করেছি । কিন্তু আমি এমন অনুপম -
সুন্দর রুপ কখনো দর্শন করিনি ! আমি বিনীতভাবে প্রার্থনা
করছি যে আপনাদের এই দিব্য শুভ রুপ এই ধরণীতে কোথাও
প্রকট করুন যাতে প্রত্যেকেই আপনার এই সবচেয়ে বিশিষ্ট,
সর্বোত্তম মহাভাব- প্রকাশ-রুপ দর্শন করতে পারে ।" তাঁর পরম
ভক্ত নারদ মুনির অভিলাষ পূর্ণ করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই
রুপ প্রকটিত করেছেন এবং এইরুপে তিনি নিক্যকাল
শ্রীক্ষেত্র, পুরুষোত্তম ধামে বিরাজ করছেন ।
শ্রীজগন্নাথদেবের লীলাকথামৃত,
[*সংগ্রহীতপোষ্ট*]
[*সংগ্রহীতপোষ্ট*]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন