"নীলাচলনিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে।
বলভদ্র সুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায় তে নমঃ।"
সরলার্থ::পরমাত্মা স্বরূপ যারা নিত্যকাল-নীলাচলে বসবাস করেন, সেই বলদেব, সুভদ্রা ও জগন্নাথদেবকে প্রণতি নিবেদন করি।
#জগন্নাথদেব কে?
যেই গৌর, সেই কৃষ্ণ, সেই জগন্নাথ। ভগবান জগন্নাথদেব হলেন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং যিনি জগতের নাথ বা জগদীশ্বর। সংস্কৃতি ভাষায় জগৎ অর্থে বিশ্ব এবং নাথ অর্থে-ঈশ্বর বোঝায়। সুতরাং জগন্নাথ শব্দের অর্থ হলো জগতের ঈশ্বর বা জগদীশ্বর।
#জগন্নাথদেবের কেন এই রূপ?
একদা দ্বারকায় মহিষীগণ রোহিনী মাতাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, কৃষ্ণকে এতো সেবা করার পরও তিনি যেন অতৃপ্ত এবং অন্যমনস্ক থাকেন। কখনো বৃন্দাবন, কখনো শ্রীদাম-সুদাম, কখনো মাতা যশোদা, নন্দবাবা, আবার কখনো বা হে ব্রজবাসীগণ বলতে বলতে মূর্ছা যান। তার কারণ কী? তখন কৃষ্ণ বলরামের অজ্ঞাতে সুভদ্রা দেবীকে একটি কক্ষের দ্বারে রেখে কক্ষাভ্যন্তরে রোহিনী মাতা মহিষীদের কাছে ব্রজবাসীদের কৃষ্ণ বিরহের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, বৃন্দাবনের বৃক্ষরাজি, তরুলতা কৃষ্ণ বিরহে ফুলে ফলে সুশোভিত হয় না। গো, গো বৎস এবং সখাগণ অনাহারে অনিদ্রায় কালাতিপাত করছে। মা যশোদা, পিতানন্দ প্রতিদিন ছানা মাখন নিয়ে গোপাল গোপাল বলে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেছেন। কৃষ্ণ বিহনে ব্রজগোপীগণ প্রাণান্তর প্রায়। এদিকে ভগিনী সুভদ্রা দেবীকে একটি কক্ষের দ্বারে দেখতে পেয়ে কৃষ্ণ এবং বলরাম তার কাছে এসে দাঁড়ালেন। কক্ষাভ্যন্তর থেকে ভেসে আসা ধ্বনি, রোহিনী মাতা কর্তৃক বর্ণিত ব্রজবাসীগণের কৃষ্ণ-বিরহ-সন্তাপাবস্থার কথা শ্রবণ করতে করতে কৃষ্ণ, বলরাম এবং সুভদ্রা বিকারগ্রস্ত হতে লাগলেন। তাদের হস্ত-পদ শরীরাভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হতে লাগলো। চক্ষুদ্বয় বিস্ফোরিত হতে লাগলো। এমতাবাস্থায় সেখানে নারদ মুনি উপস্থিত হয়ে সেই রূপ দর্শন করলেন। তখন নারদ মুনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করলেন, হে ভগবান আমি আপনার যে রূপ দেখলাম, ভক্ত বিরহে আপনি স্বয়ং বিকারগ্রস্ত হয়ে থাকেন, কৃপা করে আপনার এই করুণার মূর্তি জগতবাসীর কাছে প্রকাশ করুন। নারদ মুনির প্রার্থনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে দারুব্রহ্ম (জগন্নাথ) রূপে শ্রীক্ষেত্র বা পুরীতে আমি এই রূপে আবির্ভূত হবো। পরবর্তীতে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্য বংশীয় এক বিষ্ণু ভক্ত রাজা মালদেশের অবন্তী নগরীতে রাজত্ব করতেন। তিনি ভগবানের সাক্ষাৎকার লাভ করার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়েছিলেন। ভগবৎ প্রেরিত কোনো এক বৈষ্ণব তখন শ্রীইন্দ্রদ্যুম্নের রাজসভায় উপস্থিত হয়ে কথা প্রসঙ্গে ভগবান শ্রী নীলমাধব বিগ্রহের কথা জ্ঞাপন করলেন। রাজা এই সংবাদ প্রাপ্ত হয়ে শ্রী নীলমাধবের অনুসন্ধানে ব্রাহ্মণদের বিভিন্ন দিকে প্রেরণ করলেন। একে একে সকলেই বিফল মনোরথ হয়ে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করলেন। একমাত্র রাজপুরোহিত বিদ্যাপতি বহুস্থান ভ্রমণ করতে করতে নীলমাধব বিগ্রহের সন্ধান পেলেন এবং রাজাকে নীলমাধবের সংবাদ জানালেন। তারপর রাজপুরোহিত বিদ্যাপতির পথ নির্দেশনায় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন মন্ত্রীগণ এবং সৈন্য সামন্ত সমভিব্যাহারে নীলমাধবকে আনতে গেলেন। কিন্তু যে স্থানে নীলমাধবের সন্ধান পেয়েছিলেন সেই একই স্থানে উপনীত হলেন বটে তবে সেখানে নীলমাধবকে দেখতে পেলেন না। নীলমাধব সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। অতঃপর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ভগ্ন মনোরথে সবাইকে নিয়ে রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করলেন। নীলমাধবের দর্শন না পেয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন অনশনব্রত অবলম্বনপূর্বক প্রাণত্যাগের সংকল্প করলেন। তখন শ্রী জগন্নাথদেব স্বপ্নে তাকে বললেন, তুমি চিন্তা করিও না, সমুদ্রে ‘বাঙ্কমুহান’ নামক স্থানে দারুব্রহ্মরূপে ভাসিতে ভাসিতে আমি উপস্থিত হইবো। সে কথা শুনে রাজা পর্ষদবৃন্দ নিয়ে ঐ স্থানে উপস্থিত হলেন এবং যথাসময়ে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মাঙ্কিত শ্রী দারুব্রহ্মকে দর্শন করলেন। সেই দারুব্রহ্ম (কাষ্ঠখন্ড) রাজা বহু বলবান লোক, হস্তি প্রভৃতি নিযুক্ত করে সুবর্ণের রথে করে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে আসলেন।
পরবর্তীতে সেই কাষ্ঠখন্ড দিয়ে রাজা এক অজ্ঞাত বৃদ্ধ ভাস্করকে শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি তৈরি করতে অনুরোধ করলেন। ভাস্করটি এই কার্যভার গ্রহণ করলেও একটি শর্ত আরোপ করেছিলেন যে, কার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে ২১ দিন সম্পূর্ণ গোপনীয়তা পালনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। রাজা সম্মত হলেও শেষ পর্যন্ত অধৈর্য হয়ে ওঠেন। অবশেষে ১৫ দিন পরেই ভাস্করের কর্মশালায় গিয়ে তিনি দৃষ্টিক্ষেপ করা মাত্রই ভাস্কর অদৃশ্য হলেন। পড়ে থাকলো শ্রী শ্রী জগন্নাথ, শ্রীবলরাম ও সুভদ্রাদেবীর শ্রীমূর্তি, যা আজ আমরা দেখে থাকি। রাজা তখন সেই মূর্তিটিকে অসম্পূর্ণ ভেবে অনুশোচনা করতে লাগলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন কেন আমি ভাস্করের কথা মতো আরো কিছু দিন অপেক্ষা করলাম না। তখন ভগবান জগন্নাথদেব আবারো রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে স্বপ্নে বললেন, আমি এই রূপেই তোমার কাছে সেবা পেতে চাই। এই রূপ আমার করুণার মূর্তি। রাজা তখন সেই মূর্তিকে সম্পূর্ণ বলে গ্রহণ করে শ্রীজগন্নাথ, শ্রী বলদেব ও সুভদ্রাদেবীর সেবা-পূজা করতে শুরু করলেন এবং তারপর পুরীতে জগন্নাথদেবের জন্য একটি সুবিশাল মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
#রথযাত্রা উৎসবের অর্থ কী?
বৃন্দাবন ত্যাগ করে মহারাজ নন্দ সূত শ্রীকৃষ্ণ তার দ্বারকা লীলায় রত হলেন। সূর্যগ্রহণ উপলক্ষ্যে শ্রীকৃষ্ণ যখন কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিলেন তখন তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরাম ও ভগিনী সুভদ্রা এবং সেই সঙ্গে দ্বারকা থেকে অনেকেই তার সঙ্গে গিয়েছিলেন। সেই সময় ব্রজবাসীগণও সূর্যগ্রহণ উপলক্ষ্যে কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রে বৃন্দাবনের গোপ গোপীদের সঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হলো। ব্রজবাসীগণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার লীলাস্থলী বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। ব্রজবাসীগণ শ্রীকৃষ্ণের রাজবেশে দেখতে চাইলেন না। তারা শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবনের গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে ব্রজের বেশে দেখতে চাইলেন এবং তার সাহচর্য পেতে উন্মুখ হলেন। তখন ব্রজবাসীগণ কৃষ্ণ, বলরাম এবং সুভদ্রাদেবীর রথের ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই রথ টানতে টানতে বৃন্দাবনে নিয়ে গেলেন। যাই হোক, সেই লীলাকে স্মরণ করে ভক্তরা আজো পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বা জগন্নাথ দেবকে রথে করে টেনে বৃন্দাবনে (গুন্ডীচা মন্দির) নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। দ্বারকা রাজ্য যেমন শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য লীলার স্থান বৃন্দাবন তেমনি মাধুর্য লীলার স্থান। ভগবদগীতায় নিশ্চিত করা হয়েছে যে, যেখানে কৃষ্ণ বা জগন্নাথ, জগতের নাথ এবং তার ভক্ত বিরাজমান সেখানেই বিজয় অনিবার্য।
#রথযাত্রা উৎসবে অংশগ্রহণ করার মাহাত্ম্য কী?
এই উৎসবে অংশগ্রহণ করার মানে হলো আত্মোপলব্ধির পথে এক ধাপ অগ্রসর হওয়া। রথযাত্রা শ্রীকৃষ্ণের একটি অন্যতম লীলা। তাই এই উৎসবে অংশগ্রহণ করার অর্থ হলো সরাসরি কৃষ্ণের সংস্পর্শে আসা। যারা মন্দিরে এসে ভগবানকে দর্শন করেন না, তাদেরকে দর্শন দেয়ার জন্য ভগবান জগন্নাথদেব ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে নিজেই পথে বের হন। রথারূঢ় জগন্নাথদেবের রথের রশি ধরে টানে বা রথ স্পর্শী করে অথবা বিগ্রহকে দর্শন করে তাহলে তার মুক্তি সুনিশ্চিত। সনাতন ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎসবসমূহের মধ্যে রথযাত্রা অন্যতম উৎসব। এই উৎসব আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করে। হৃদয়ের সুপ্ত কৃষ্ণভাবনাকে জাগ্রত করার এটি একটি সহজ ও সরল পন্থা।
#শাস্ত্রে তাই উল্লেখ করা হয়েছে
“রথে চ বামনাং দৃষ্ট পুনর জন্ম ন বিদ্যতে”
যদি কেউ রথযাত্রা উৎসবের সময় রথারূঢ় জগন্নাথদেবের শ্রী বিগ্রহকে দর্শন করে, তাহলে তার আর জড় জগতে জন্মগ্রহণ করতে হয় না। তিনি চিন্ময় ধাম প্রাপ্ত হন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ভক্তদের নিয়ে জগন্নাথের রথের সম্মুখে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।’ কীর্তন করতে করতে নৃত্য করতেন। রথের সামনে নৃত্য কীর্তন করাই জগন্নাথকে সন্তুষ্ট করার সর্বোত্তম পন্থা। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর এই লীলার মাধ্যমে সেই শিক্ষা আমাদের প্রদান করেছেন। তাই যে কেউ ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রায় যোগদান করে নৃত্য কীর্তন করার মাধ্যমে দুর্লভ মনুষ্য জীবনকে সার্থক করতে পারেন।
#লেখক: ডা . সুব্রত ঘোষ