দেবতা ও ভগবানের পার্থক্য?
সাধারণত হিন্দু সমাজে কিছু মানুষ
দেবতা ও
ভগবানের পার্থক্য জানে না। ইন্দ্র, চন্দ্র,
বরুণ, শিব, দুর্গা, কালী প্রভৃতি
দেবতাদের
সঙ্গে বিষ্ণু, নারায়ণ, রাম, নৃ্সিংহ, বামন
প্রভৃতি ভগবানের সম পর্যায়ভুক্ত বলে
মনে
করে থাকেন। এটি আমাদের জানা উচিত
যে
ভগবান ও দেবতাদের মধ্যে বিরাট
পার্থক্য
আছে। যেমন- দেবতারা হচ্ছেন ভগবানের
দ্বারা নিযুক্ত এ জড়জগতের বিভিন্ন
কার্য
সম্পাদনের নিয়ন্ত্রণ কর্তা। যে ভাবে
অগ্নি
দেবতা অগ্নি নিয়ন্ত্রণ করেন; বরুণদেব
জলের
নিয়ন্ত্রণ করেন; বায়ু দেবতা বায়ু
নিয়ন্ত্রণ
করেন ইত্যাদি। শাস্ত্র অনুসারে
দেবতারা
জীবতত্ত্ব। যে কোন জীব ভগবান থেকে
বিশেষ শক্তি প্রাপ্ত হয়ে দেবতাদের
আসন
গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু ভগবান
জীবতত্ত্ব
নন, তিনি হচ্ছেন বিষ্ণু তত্ত্ব। দেবতাদের
আধিপত্য এই জড়জগতে সীমাবদ্ধ, কিন্তু
ভগবানের আধিপত্য বা ঐশ্বরত্বের
প্রভাব জড়
ও চিন্ময় জগত সর্বত্র ব্যাপ্ত। দেবতারা
মানুষকে একমাত্র ভৌতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য
প্রদান করতে পারেন, কিন্তু মুক্তি দিতে
পারেন না। ভগবান জীবকে মুক্তি প্রদান
করতে পারেন। দেবতারা মায়াধীন,
কিন্তু
ভগবান হচ্ছেন মায়াধীশ। সৃষ্টি ও
প্রলয়কালে
দেবতাদেরও প্রভাবিত হতে হয়, কিন্তু
ভগবান
নিত্য বর্তমান এবং তার ধামও নিত্য
বর্তমান।
এইভাবে ইন্দ্রলোক, চন্দ্রলোক প্রলয়ের
সময়ে
সব ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। কিন্তু ভগবানের
ধাম-
বৈকুণ্ঠ, অযোধ্যা, গোলক বৃন্দাবন
ইত্যাদি
ধ্বংস প্রাপ্ত হবে না। ইন্দ্র, চন্দ্র প্রভৃতি
দেবতাগণ প্রকৃতির তিনটি গুণ দ্বারা
পরিচালিত হয়ে থাকেন। কিন্তু ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ, রাম, নারায়ণ প্রভৃতি গুণাতীত।
তাদের কার্যকলাপ প্রকৃতির তিনটি গুণ
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। সাধারণ মানুষ
এই
সমস্ত পার্থক্য বুঝতে পারে না। দেবতা ও
ভগবানকে এক বা সমপর্যায় বলে মনে
করে
থাকে। এটি অবশ্য জেনে রাখা উচিত
আমাদের বৈদিক সাহিত্যে তেত্রিশ
কোটি
দেবতাদের বর্ণনা করা হয়েছে।
শাস্ত্রানুসারে যারা বিভিন্ন জাগতিক
সুখ-
স্বাচ্ছন্দ্য বা বিভিন্ন ফল অতি সত্ত্বর
লাভ
করতে চান, তারা ভিন্ন ভিন্ন দেবতাদের
উপাসনা করতে পারেন। কিন্তু সেটি
বুদ্ধিমান মানুষের কাজ নয়, কেননা
জাগতিক
ফল অনিত্য। যারা বুদ্ধিমান ব্যক্তি তারা
ভগবানের শরণাগত হন। এভাবে সমস্ত
দেবতাদেরকে ভগবান বলে উপাসনা করা
ঠিক
নয়। তার সঙ্গে সঙ্গে এটুকুও জানতে হবে
যে
দেবতাদের ভগবানের সমান না হলেও
তাঁরা
ভগবানের অতি নিজজন, তাঁরা পূজ্য, তাই
দেবতাদের শ্রদ্ধা করা মানুষের কর্তব্য।
দেবতাদের পূজা করা যেতে পারে,
শ্রদ্ধা
করা যেতে পারে, কিন্তু ভগবানকে ভক্তি
করতে হয়। এভাবে মানুষের ভগবান ও
দেবতাদের মধ্যে পার্থক্য জেনে
শ্রদ্ধাযুক্ত
হয়ে ভগবানের ভক্ত হওয়া কর্তব্য। তা না
হলে
দুর্লভ মনুষ্য জীবনের আসল লক্ষ্যে
পৌছাতে
পারবে না। ভগবদ্গীতায় বর্ণনা করা
হয়েছে-
যান্তি দেবব্রতা দেবান্ পিতৃন্ যান্তি
পিতৃব্রতাঃ।
ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা যান্তি
মদ্যাজিনোহপি মাম্।।
(ভঃগী ৯/২৫)
দেবতাদের উপাসনা করলে দেবলোক
যাবে,
পিতৃপুরুষদের উপাসনা করলে পিতৃলোক
যাবে,
ভূত-প্রেতের পূজা করলে ভূতলোক যাবে।
কৃষ্ণের উপাসনা করলে কৃষ্ণের ধামে
যাবে।
দেবতাদের পূজা করে দেবলোক যাবে
এবং
কৃষ্ণের পূজা করে কৃষ্ণ লোক যাবে- এটার
মধ্যে পার্থক্য হল- দেবলোক যাওয়ার পর
পুণ্য
শেষ বা ক্ষয় হলে আবার মর্ত্যলোকে
ফিরে
আসতে হবে। ভগবদ্গীতায় বলা
হয়েছে-“আব্রহ্মভূবনাল্লোকাঃ
পুনরাবর্তিনোহর্জুন” কিন্তু ভগবদ্ধামে
গিয়ে
ভগবানকে প্রাপ্ত হলে আর এ জড়জগতে
ফিরে আসতে হবে না। “ মামুপেত্য তু
কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে”।“যদ্ গত্বা ন
নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম”। এভাবে
দেখানো হয়েছে জীবনের আবর্ত থেকে
অর্থাৎ বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে হলে
জীবনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত
হওয়া|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন