আমাদের ধর্মের নাম নাকি কোনো শাস্ত্রে নেই ।। দেখুন
অন্য ধর্মাবলম্বীরা সনাতনীদের কিছু কমন প্রশ্ন করে। আবার মাঝে মাঝে নিজের ধর্মীয় গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়ে নিজেদের বড় ও সনাতনকে ছোট দেখানোর তালে থাকে। চলুন আজ তাদের কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাক........
১. আমাদের ধর্মের নাম যে সনাতন তার উল্লেখ নাকি আমাদের কোনো ধর্মীয় গ্রন্থে না! আসলেই কী তাই.......
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে অর্জুন তাঁর বিপক্ষে নিজের আত্মীয়দের দেখে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন,
Unnamed (1)
কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্মাঃ সনাতনাঃ।
ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্মোহভিভব ত্যুত।।
(গীতা-১/৪০)
অর্থাৎ নিজেদের কুলকে বিনাশ করলে আমাদের কুলধর্ম সনাতন নষ্ট হয়ে যাবে। তখন আমাদের সম্পূর্ণ কুলে বহুপ্রকারে পাপ প্রবেশ করবে।
এখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, অর্জুন বলেছেন তাঁদের কুল ধর্ম হচ্ছে সনাতন। এবং নিজেরা নিজেদের বিনাশ করলে সনাতন ধর্মের ক্ষয় হবে এবং কুলে পাপ প্রবেশ করবে।
মনুসংহিতার ৪/১৩৮ এ বলা হয়েছে,
সত্যং ব্রৃয়াৎ প্রিয়ং ব্রৃয়ান্ন ব্রৃয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্।
প্রিয়ঞ্চ নানৃতং ব্রৃয়াদেষ ধর্মঃ সনাতনঃ।।
অর্থাৎ সত্যকথা বলবে, প্রিয় বাক্য বলবে, কিন্তু সত্য কথাও যদি শ্রোতার মর্মভেদী অপ্রিয় হয় তা বলবে না; আবার মিথ্যা প্রিয় বাক্য বলবে না। - এই গলো বেদোপদিষ্ট সনাতন ধর্ম।
আবার মনুসংহিতার ১/২২-২৩ এ বলা আছে, "যজ্ঞঞ্চৈব সনাতনম" ও "ব্রহ্ম সনাতনম" অর্থাৎ যজ্ঞ হচ্ছে সনাতন এবং ব্রহ্ম হচ্ছে সনাতন।
অর্থাৎ আমাদের ধর্ম সনাতন, আমাদের যজ্ঞরূপ কর্ম সনাতন এমনকি ঈশ্বরও সনাতন।
২. সনাতন ধর্মের প্রবর্তক কে? এটা হচ্ছে তাদের আরেকটি প্রশ্ন।
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, প্রবর্তক কাকে বলে? যিনি কিছু কোনো প্রবর্তন অর্থৎ চালু করেন তাকে প্রবর্তক বলে। যদি অন্য ধর্মের প্রবর্তক থাকে তাহলে এটাই স্পষ্ট হয় যে, এই ধর্মগুলো সেইসব মানুষের প্রবর্তিত, ঈশ্বর প্রবর্তিত নয়।
অপর দিকে, সনাতন ধর্ম শাস্ত্রে বলা হয়েছে, "ধর্মোমূল হি ভগবান......" অর্থাৎ এই ধর্মের মূল বা প্রবর্তক হচ্ছে স্বয়ং ঈশ্বর। তাই এটাই হচ্ছে প্রকৃত ঈশ্বর নির্দেশি ধর্ম।
৩. সনাতন ধর্ম যে সত্য ধর্ম তার উল্লেখ কোন গ্রন্থে আছে?
মুণ্ডক উপনিষদের ৩/১/৬ এ বলা হয়েছে,
সত্যমেব জয়তে নানৃতং সত্যেন পন্থা বিততো দেবযান।
য়েনাক্রমন্তৃষ্যয়ো হ্যাপ্তকামা যত্র তত সত্যস্য পরম নিধানম।।
অর্থাৎ সত্যের জয় ও অসত্যের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। সত্য পথের মাধ্যেমে প্রচীন কালে ঋষিগণ সেই পরম সত্যের কাছে গমন করেছেন।
এখানে দেখা যাচ্ছে, ঋষগণ যে পথ অনুসরণ করেছেন তাকে সত্য পথ বলা হয়েছে। ঋষিগণ নিশ্চয় সনাতন ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্ম পালন করেন নি। আরও বলা হয়েছে এই পথের মাধ্যমে পরম সত্য অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছে গমন করা যায়। তাই সনাতনই সত্য ধর্ম।
৪. আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ যে ঈশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত তার উল্লেখ কোথায় আছে?
এই কথাটির উল্লেখ বেদ, উপনিষদ গীতায় অনেকবার উল্লেখ আছে। আমি শুধু বেদের থেকে উল্লেখ করছি।
শুক্লযর্জুবেদে (৩১/৭) বলা হয়েছে,
তস্মাদ্যজ্ঞাৎ সর্ব্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিবে।
ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাদ্যজু তস্মাদ জায়ত।।
অর্থাৎ সেই পরমপূজ্য পরমাত্ম হতে ঋক, সাম, অথর্ব ও যর্জুবেদ উৎপন্ন হয়েছে।
উদুত্যং জাতবেদসং দেবং বহন্তি বেতবঃ।
দৃশে বিশ্বায় সূর্য্যম্। ।
(অথর্ববেদ-১৩/২/১৬)
অর্থাৎ হে জগদীশ্বর! তুমিই বেদের উৎপাদক ও প্রকাশ স্বরূপ। সকলে তোমার মহিমা দেখার জন্য সংসারে পতাকার মতো কাজ করছে।
অংতি সন্তং ন জহাত্যস্তি সন্তং ন পশ্যতি ।
দেবস্য পশ্য ন মমার ন জীর্যাতি।।
(অথর্ববেদ-১০/৮/৩২)
অর্থাৎ, মানবগণ তাদের সমুবর্তী পরমাত্মাকে দেখে আবার তাঁকে ছাড়তেও পারে না। পরমাত্মার কাব্য বেদকে দেখো, তা মরেও না জীর্ণও হয় না।
৫. একমাত্র বেদ ও সনাতন ধর্ম সমগ্র মানব জাতির জন্য। তার প্রমাণ হচ্ছে.....
যথেমাং বাচং কল্যাণীমাব্দানি জনেভ্যঃ।
ব্রহ্ম রাজন্যভ্যাং শূদ্রায় চার্য্যায় চ স্বায় চারণায়।
প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ভূয়াসম্য়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু।।
(শুক্লযর্জুবেদ-২৬/২)
অর্থাৎ ঈশ্বর মানবের প্রতি উপদেশ দিচ্ছেন যে, আমি যেমন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, বৈশ্য, স্ত্রী, সেবকাদিদের মঙ্গলময় বেদ বাণী উপদেশ দিয়েছি তোমরাও সেই রকম তোমরাও সেইরূপ করো। বেদবাণীর উপদেশ দিয়ে আমি যেরকম বিদ্বানদের প্রিয় হয়েছি, তোমরাও সেইরূপ হও। দানের জন্য আমি যেরূপ দানশীলদের প্রিয় হয়েছি, তোমরাও সেরূপ হও। আমার ইচ্ছা বেদের প্রচার বৃদ্ধি হোক। সর্বজ্ঞান সম্পন্ন বেদবাণী গ্রহণ ও প্রচার করে মোক্ষ সুখ লাভ করো।
আমদের ধর্ম আমাদের শিক্ষা দেয় সকলের জন্য প্রার্থণা করতে, "সর্বে ভবন্তু সুখীন.....মা দুঃখ ভব্যতে।" বেদ আমাদের শিক্ষা দেয়, "তোমরা একসাথে চল, একসাথে আলোচনা করো। তোমাদের সকলের মন এক হোক, হৃদয় এক হোক। তোমরা একসাথে মিলে চল। তোমাদের লক্ষ্য সমান হোক, চিত্ত সমান হোক।" (ঋগ্বেদ-১০/১৯১/২-৪)
এমন বিশ্বজনীন কথা সনাতন ধর্ম ছাড়া আর কোথাও নেই। তাই সনাতনই একমাত্র বিশ্বজনীন ধর্ম।
৬. সনাতন ধর্মের লক্ষ্য কী তা এবার বলছি.....
সনাতন ধর্মের মূল প্রাপ্তি হচ্ছে ঈশ্বর লাভ অর্থাৎ ঈশ্বরের সাথে একাত্ব হয়ে যাওয়া। যতক্ষণ না মোক্ষ লাভ হচ্ছে ততক্ষণ মানুষ জন্ম মৃত্যুতে আবদ্ধ থাকবে।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ১/৭ ও গীতার ৮/১৫ তে বলা হয়েছে, সিদ্ধি প্রাপ্ত মহামানবগণ বেদ বর্ণিত সাধনার দ্বারা ঈশ্বরকে প্রাপ্ত হন এবং জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হয়।"
৭. সনাতন ধর্মে দেব পূজা নিষিদ্ধ নয়।
"যে যে সকামযুক্ত ভক্ত যে যে দেবতার স্বরূপকে শ্রদ্ধার সাথে পূজা করতে চায়, সেই সেই ভক্তের শ্রদ্ধাকে আমি সেই দেবতার প্রতি স্থির করে দেই। ঐ ভক্ত শ্রাদ্ধার সাথে যুক্ত হয়ে ঐ দেবতার পূজা করতে চেষ্টা করে আর সেই দেবতা থেকে আমারই বিহিত ফলাফল লাভ করে। " (গীতা- ৭/২১-২২)
দেবতাপূজার ফল স্বরূপ সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হচ্ছে স্বর্গ। যেহেতু স্বর্গ মানবের স্থায়ি স্থান নয়, ওখান থেকে পূণ্য শেষ হলে মানুষকে আবার জন্ম গ্রহণ করতে হয়। সেইজন্য স্বর্গকে উপেক্ষা করা হয়। যারা স্বর্গ যেতে চায় তারাই দেবতা পূজা করে। এতে মানবের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি মোক্ষ লাভ হয় না। এই জন্য দেবতাপূজাকে অন্ধকারের সাথে তুলনা করা হয়েছে। " কামনা বাসনা যুক্ত হয়ে যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে তারা নিজ স্বভাব অনুসারে অন্যান্য দেবতাদের পূজা করে।" (গীতা-৭/২০)
এথেকে বোঝা যায়, সনাতনে দেব পূজা নিষিদ্ধ নয়। দেবতাপূজায় শুধু মোক্ষ প্রাপ্তি হয়না।
৮. এবার চলুন দেখে নেওয়া যাক, যারা বেদানুসারে ঈশ্বর উপাসনাও করে না আবার দেবতাপূজাও করে না তাদের কী হবে........
এই সম্পর্কে ঈশোপনিষদের ১২ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে,
অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহসম্ভূতিমুপাসতে।
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ সম্ভূত্যাংরতাঃ।।
অর্থাৎ যে মানুষগণ বিনাশশীল দেবতা মানুষ ইত্যাদির পূজা করে তারা অন্ধকারে প্রবেশ করে (যেহেতু তা মোক্ষদায়ী নয়)। কিন্তু যে মানুষগণ অবিনাশী ঈশ্বরের মিথ্যা উপাসনায় মত্ত, তারা আরও ঘোরতম অন্ধকারে প্রবেশ করে।
৯. যারা বেদ বিরোধী তাদেরকে কী বলা হয়েছে..... "পাষণ্ডস্থাংশ্চ মানবান"(মনুসংহিতা-৯/২২৫) অর্থাৎ বেদবিদ্বেষী ব্যক্তিরা হচ্ছে পাষণ্ড।
যারা ঈশ্বরকে উপাসনা করেনা তাদের সম্পর্কে গীতার ৭/১৫ তে বলা হয়েছে, "যারা আমার (ঈশ্বরের) ভজনা করে না তাদের জ্ঞান মায়া দ্বারা অপহৃত, অসুর, দূষিত কর্মকারী, নরাধম ও মূঢ়।"
১০. সনাতন ধর্মে অন্যদের ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ.......
"বেদ অখিল ধর্মের মূল"- মনু.-২/৬।
"বেদ পিতৃগণ, দেবগণ ও মনুষ্যগণের পক্ষে সনাতন চক্ষু স্বরূপ। বেদ কোন মানুষের পক্ষে প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। মীমাংসাশাস্ত্র নিরপেক্ষভাবে ঐ বেদশাস্ত্রের তত্ত্ব অবগত হওয়া অসম্ভব, এটি স্থির সিদ্ধান্ত। "-মনু.-১২/৯৫।
এবার বৈদিক ধর্মগ্রন্থ ব্যতিত আর যেসকল তথাকথিত ধর্মগ্রন্থ আছে তাদের সম্পর্কে বলা আছে, "বেদবাহ্য যেসব গ্রন্থ আছে এবং যে সব শাস্ত্র কুদৃষ্টিমূলক অর্থাৎ অসৎ তর্কযুক্ত মতবাদ যুক্ত যে শাস্ত্র আছে, সেগুলি শেষ পর্যন্ত একেবারে নিষ্ফল এবং সেগুলো মানবকে তমযোনি অর্থাৎ অজ্ঞান জন্মে নিয়ে যায়। এই বেদাদি ছাড়া আর যত কিছু শাস্ত্র আছে সেগুলি মানবদ্বারা কল্পিত কালক্রমে উৎপন্ন। সেগুলো অর্বাচীন কাল ও মিথ্যা।" -মনুসংহিতা-১২/৯৫-৯৬
শেয়ার করে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিন
Collected
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন